একটি কণ্ঠের নীরব হয়ে যাওয়া: শরিফ ওসমান হাদি

একটি কণ্ঠের নীরব হয়ে যাওয়া: শরিফ ওসমান হাদি

একটি কণ্ঠের নীরব হয়ে যাওয়া: শরিফ ওসমান হাদি

কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা শুধু জীবিত অবস্থায় নয়—মৃত্যুর পরও সমাজকে নাড়া দেন। শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন ঠিক তেমনই একজন মানুষ। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন কেবল একটি সংগঠনের প্রতিনিধি নন, বরং সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক অদম্য কণ্ঠ। তাঁর চলে যাওয়া মানে শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়; এটি একটি স্বপ্ন, একটি সাহসী উচ্চারণ, একটি আন্দোলনের হৃদয়ে গভীর ক্ষত।

হাদি ছিলেন সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি, যারা চুপ করে থাকার বিলাসিতা রাখে না। অন্যায়ের সামনে নীরবতা নয়, প্রতিবাদই ছিল তাঁর ভাষা। রাজপথে, সমাবেশে, বক্তব্যে—সবখানেই তিনি ছিলেন স্পষ্ট, দৃঢ় এবং আপসহীন। তাঁর কণ্ঠে ছিল ক্ষোভ, কিন্তু সেই ক্ষোভের ভেতর লুকিয়ে ছিল মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা। তিনি বিশ্বাস করতেন, পরিবর্তন আসবেই—যদি কেউ সত্য বলার সাহস রাখে।

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে হাদি কখনো নিজেকে আলাদা করে দেখাননি। তিনি বলতেন “আমি নই, আমরা।” এই “আমরা”-র ভেতর ছিল বঞ্চিত মানুষ, অবহেলিত কণ্ঠ, স্বপ্নভাঙা তরুণেরা। তিনি রাজনীতি করতেন ক্ষমতার জন্য নয়, দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে। তাঁর নেতৃত্ব ছিল উচ্চকণ্ঠ নয়, বরং দৃঢ় উপস্থিতি—যেখানে কথার চেয়ে দায়িত্ব বড়।

যে দিন তিনি গুলিবিদ্ধ হন, সে দিনটি শুধু একটি সহিংস ঘটনার দিন ছিল না; সেটি ছিল সমাজের বিবেককে প্রশ্ন করার দিন। একজন মুখপাত্রকে, একজন কণ্ঠকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা মানেই কি একটি আন্দোলন থেমে যায়? হাদির জীবন সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েই শেষ হয়েছে—না, থামে না। কারণ আদর্শকে গুলি করা যায় না।

সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে মৃত্যুর খবর আসার পর দেশজুড়ে যে শূন্যতা নেমে আসে, তা বোঝানো কঠিন। যারা তাঁকে কাছ থেকে চিনতেন, তারা হারালেন একজন সহযোদ্ধা। যারা দূর থেকে অনুসরণ করতেন, তারা হারালেন এক অনুপ্রেরণা। আর যারা কখনো তাঁর সঙ্গে একমত ছিলেন না, তারাও হারালেন এমন একজন মানুষকে—যিনি কথা বলতেন সোজাসাপ্টা, ভয়ের তোয়াক্কা না করে।

হাদির মৃত্যু আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয়, সত্য বলার মূল্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও শেখায়—এই মূল্য দিয়েও কিছু মানুষ পিছিয়ে যান না। তাঁর জীবন ছিল অসম্পূর্ণ, কিন্তু অর্থহীন নয়। তিনি হয়তো অনেক স্বপ্ন পূরণ করে যেতে পারেননি, কিন্তু যে স্বপ্নগুলো তিনি জাগিয়ে গেছেন, সেগুলো এখন হাজার মানুষের চোখে।

আজ ইনকিলাব মঞ্চ হয়তো একজন মুখপাত্র হারিয়েছে, কিন্তু তার ভাষা হারায়নি। কারণ হাদি কোনো একক ব্যক্তি ছিলেন না; তিনি ছিলেন একটি ধারার নাম। তাঁর কণ্ঠ এখন আর শোনা যাবে না, কিন্তু তাঁর কথা মানুষের স্মৃতিতে, লেখায়, প্রতিবাদে বারবার ফিরে আসবে।

ইতিহাস অনেক সময় নীরবে রক্তের দাগ মুছে ফেলে। কিন্তু কিছু নাম থাকে, যেগুলো মুছতে পারে না। শরিফ ওসমান হাদি তেমনই একটি নাম। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন—ভয় নয়, নীরবতা নয়, বরং সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই মানুষের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।

আজ তিনি নেই। কিন্তু প্রশ্নগুলো রয়ে গেছে। দায়িত্বগুলো রয়ে গেছে। আর রয়ে গেছে সেই অঙ্গীকার—যে অঙ্গীকার হাদি নিজের জীবন দিয়ে আমাদের মনে গেঁথে দিয়ে গেছেন।

একটি কণ্ঠ নীরব হয়েছে, কিন্তু প্রতিবাদ থামেনি।

⭐ 0.0 / 5 (0 reviews)

💬 Comments

No comments yet. Be the first to comment!